কমরেড দীপেন দত্ত স্মরণে

সত্যেশ ভট্টাচার্য

গত ২২ জুলাই  সকালে শিলং শহরের নাজারেথ হাসপাতালে আমাদের পার্টি পি সি সি সিপিআই (এম-এল)-এর প্রবীণ কর্মী কমরেড দীপেন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় ওনার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

   ১৯৬৭ সালের মে মাসে নক্সালবাড়ীর বজ্রনির্ঘোষ শিলং শহরের যে ক’জন যুবককে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল তার অন্যতম ছিলেন দীপেন দত্ত। কমঃ দীপেন মানু দাশগুপ্ত, সুভাষ ভট্টাচাৰ্য, জগৎজ্যোতি রায়, হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচাৰ্যদের সাথে করে নিয়ে শিলং শহরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেওয়াল লিখন, পোষ্টারিং প্রভৃতির মাধ্যমে নক্সালবাড়ীর অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই দিন থেকে নিরলস ভাবে নক্সালবাড়ীর রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে ওতঃপ্রোতভাবে যুক্ত করেছিলেন এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বার্থে কাজ করে গেছেন।

   কমঃ দীপেন ছিলেন শিলং শহরে অবস্থিত অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল অফিসের এক কর্মী । কমঃ জগৎজ্যোতি রায়ও এই একই অফিসের কর্মী ছিলেন।  দু’জনে মিলে অফিসের বেশ কয়েকজন কর্মীকে বিপ্লবী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাদের প্রচেষ্টার ফলে কর্মচারীদের মধ্যে সেই সময়ে একটি বিপ্লবী গ্রুপ গড়ে ওঠে। এই গ্রুপ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল।

   ১৯৭৭ সালে পার্টি যখন প্রকাশ্য কাজকর্ম করার সিদ্ধান্ত নিল এবং গণ আন্দোলন গণ সংগঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করল, তখন কমঃ দীপেন প্রায় এককভাবে শিলং শহরের কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের ইউনিয়নের মধ্যে , এদের বিভিন্ন আন্দোলনে বিপ্লবী রাজনীতির প্রভাব ফেলতে শুরু করলেন। কাজটা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু কমঃ দীপেন কখনও বিচলিত হননি বা নিরুৎসাহ হননি।

   অথচ, তাঁর  পারিবারিক দায়দায়িত্ব ছিল খুবই বেশি। মা, এক দাদা, অবিবাহিতা দুই বোনকে নিয়ে ছিল দীপেনের পরিবার। দাদা রোজগার করায় বিশেষ সক্ষম ছিলেন না। যদ্দুর মনে পড়ে, বোনেরাও খুব একটা শিক্ষিতা ছিলেন না। তাই গোটা সংসারের দায়িত্ব ছিল দীপেনেরই কাঁধে। পরিবারের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন দীপেন নিজেই। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরি করে (বেতন যথেষ্ট কম ছিল তখন) শিলং শহরে ঘর ভাড়া করে থেকে এই সংসার চালানো সহজ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও দীপেন যে কীভাবে প্রতি মাসে পার্টির লেভি দিতে পারতেন,  প্রয়োজনে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মীদের কাপড়-চোপড় কিনে দিতে পারতেন, ওষুধ পত্রের যোগান ধরতে পারতেন তা ভাবলে আজও বিস্ময় জাগে। সম্ভবত, মায়ের মৃত্যুর পর গৌহাটির বেলতলায় একটুকরো জমি কিনে দাদা ও বোন দুজনের থাকার জন্যে ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন দীপেন।  এদের খরচ চালানোর জন্যে প্রতি মাসেই তাকে টাকা পাঠাতে হতো। এতসব করেও পার্টির জন্যে সময় দেওয়া বা টাকা পয়সা দেওয়ায় তাঁর কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে কোনোদিন শুনিনি।

   আসামে ১৯৭৮ সাল থেকে পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ  করতে শুরু করে । এই নির্বাচনী  কাজকর্মে টাকা পয়সার যোগান ধরা, কর্মী পাঠানো এইসব দীপেন আন্তরিক ভাবে করতেন। কাছাড়ের বড়খলা বিধানসভা কেন্দ্রে কমঃ রুক্মিনী বর্মণ  এবং পরে কমঃ চন্দন সেনগুপ্তের নির্বাচনী সংগ্রামে দীপেন নিজে প্রচার অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন।

   অনেকটা বেশী বয়সে শিলং-এর লাবান এলাকার এক শিক্ষয়িত্রী রুমি দেবীকে বিয়ে করেন দীপেন। তাদের কোনও সন্তান ছিল না। সুখের যুগ্ম জীবন বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। দুজনেরই হার্টের অসুখ দেখা দিল।  ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে হার্টের বাইপাস সার্জারী করতে হল দু’জনকেই। কয়েক বছর আগে দীপেন যখন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে ব্যাঙ্গালোর এসেছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিলাম। নানা কথাবার্তা হল। তিনি যে তখনও রাজনীতিতে সক্রিয় সেটা কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন তিনি বেশ সক্রিয় ।

২০১৯ সালে আমরা একবার শিলং গেছিলাম বেড়াতে। তখন দীপেনের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর লাবানের বাড়িতে গেছিলাম।  দীপেন এবং তাঁর স্ত্রীর আন্তরিক অভ্যর্থনা বহুদিন মনে থাকবে । দীপেন বারবার বলছিল, শিলং আসলেই যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের ছোটো ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করেছিলাম পান্ডুতে । আমাদের অনুরোধে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই হার্টের রোগী হওয়া সত্ত্বেও গৌহাটি এসে সদ্য বিবাহিত বর-বধূকে আশীর্বাদ করেছিলেন।  এতটাই আন্তরিকতা ছিল কমঃ দীপেন দত্তের।

   কমঃ দীপেন কথা কম বলতেন, কাজ করতেন অনেক বেশি।  পার্টির একনিষ্ঠ নীরব কর্মীদের অন্যতম ছিলেন দীপেন।  ১৯৯৪ সালে গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত ‘Threat to diversity ‘ কনভেনশনে কমঃ দীপেনের কর্মদক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সহজ সরল জীবনযাপন করেও উচ্চমানের চিন্তাচর্চা করা , নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে অবিচল কাজ করে যাওয়াই ছিল দীপেনের জীবনের আদর্শ।

চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্রদের প্রয়োজনের কথা ভেবে দীপেন মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন। তিনি যে কতটা বিজ্ঞানমনষ্ক ছিলেন তা এ কাজ থেকেই বোঝা যায় ।

   কমঃ দীপেন দত্ত আমার মতো তাঁর অগণিত গুণমুগ্ধদের মনে, তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের অন্তরে বেঁচে থাকবেন চিরদিন।

   সংগ্রামী অভিনন্দন কমরেড দীপেন  !

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑