অরূপ বৈশ্য
আশির দশকে শেষে আসামে আর্মকা নামে ও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে “বৈচিত্র্যের প্রতি বিপদ” নামে দু’টি প্রক্রিয়া ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। দু’টি প্রক্রিয়ারই অন্তর্বস্তু ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আসামে আর্মকা প্রক্রিয়াটির জন্ম হয় বর্ণহিন্দু আধিপত্য ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকারের আন্দোলন গড়ার সচেতন প্রয়াস থেকে এবং সেটি এক গণপ্রক্রিয়ায় রূপ নেয় অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদ ও পরবর্তীতে বড়ো উগ্রজাতীয়তাবাদের সন্ত্রাসী রূপের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধের মাধ্যমে। সর্বভারতীয় “বৈচিত্র্যের প্রতি বিপদ” প্রক্রিয়াটির প্রেক্ষাপটে ছিল মণ্ডল – কমণ্ডল টানাপড়েনের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া “হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান” রাজনীতির উত্থান। অর্থাৎ উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদ বৈচিত্র্যের উপর যে আঘাত নামিয়ে এনেছিল তার প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই দু’টি প্রক্রিয়া ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করতে ও গণ-আবেগকে ছুঁয়ে যেতে সমর্থ হয়ে উঠছিল। নিচুতলার কর্মী-সমর্থকরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন এবং এই স্বপ্ন তাদের কর্মচাঞ্চল্যে ও লড়াকু মেজাজে উল্লম্ফন এনে দিয়েছিল।
নিচুতলার কর্মী সংগঠকদের সেই স্বপ্নের অবয়ব কী ছিল? সবাই জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ভাবতে শুরু করেছিল যে এই প্রক্রিয়ার অন্তিম পরিণতি হচ্ছে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকীকরণের প্রশ্নকে সমাধা করে নেওয়ার শক্তি গড়ে উঠতে চলেছে। প্রক্রিয়াগুলিতে ব্যাপক গণ-সমর্থন ও জনগণের সাড়া মেলার পেছনে শক্তি হিসাবে যারা ‘চিন্তা ও মতাদর্শের’ আধার হিসাবে কাজ করছিল তারা ছিল মধ্যবিত্ত বৌদ্ধিক শ্রেণি। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের চেতনায় সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবী এবং তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে পারার মতো স্বীকৃত ও মর্যাদাপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায় পরিচিতির বৈশিষ্ট রক্ষা ও পরিচিতির স্বাধিকারের প্রশ্নে শ্রেণি-নিরপেক্ষভাবে সমগ্র গোষ্ঠীকে একই সূত্রে গেঁথে নিতে সক্ষম হয়। সংশ্লেষিত ও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত স্বার্থে মেহনতি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণি-আবেগের অধীন অবস্থায় উপনীত হয়। উপর থেকে এধরনের ব্যাপক প্রস্তুতি গণতান্ত্রিক আবেগকে সঞ্চারিত করতে পেরেছিল। এই দু’টি প্রক্রিয়ারই মূল অনুঘটক ছিল পিসিসি সিপিআই (এম-এল) দল। নেতৃত্বরা কী মধ্যবিত্ত শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই প্রক্রিয়াকে
দেখছিলেন? এই আন্দোলনকে সচেতনভাবে গণ-প্রতিরোধ সংগ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অনুপ্রাণিত করার নিদর্শন থেকেই বোঝা যায় যে তাতে কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির অবকাশ ছিল না। সাম্রাজ্যবাদের যুগে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্ব যে গণতন্ত্রের প্রশ্ন সমাধান করতে পারে না সেই তত্ত্বগত অবস্থানেরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। একটি চলমান প্রক্রিয়ার অভ্যন্তর থেকে দেখা ও প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার পর ফিরে দেখার মধ্যে বিস্তর পরিস্থিতিগত বাধ্যবাধকতা থাকে। চলমান প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে বহু ধরনের আশাবাদ জন্ম নেওয়া স্বাভাবিক যা হয়তো পরবর্তীতে মনে হতে পারে অস্বাভাবিক, কারণ পরবর্তীকালে বাস্তব নিজেকে যেভাবে উন্মোচিত করেছে তা তখন করেনি বা এও হতে পারে যে, বাস্তব দেখাতে চাইলেও তখন যা দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত ছিল দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি।
একটি চলমান প্রক্রিয়ার অভ্যন্তর থেকে দেখা ও প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার পর ফিরে দেখার মধ্যে বিস্তর পরিস্থিতিগত বাধ্যবাধকতা থাকে।
এই আশাবাদের স্বরূপ কী হতে পারে? মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্ব শুরু হওয়া একটি গণপ্রক্রিয়া যদি বিকশিত হতে থাকে ও কঠিন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পেছনে ফেলে শ্রমিক শ্রেণি নেতৃত্ব নিতে ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে জেগে উঠবে। স্বতঃস্ফূর্ততার অভ্যন্তরে স্থান করে নেওয়া এই আশাবাদে এক সাংগঠনিক গণতান্ত্রিক অন্তর্বস্তু আছে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক অন্তর্বস্তুটি ক্রমশ বিকাশমান বাস্তবশক্তি যে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে সেদিকে নেতৃত্ব সম্ভবত যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি। আন্দোলনের জোয়ারে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রেণি সংগঠনগুলিকে কার্যত উঠিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের সম্মতি ও আন্দোলনের ভবিষ্যৎ রূপ ও পরিণতি সম্পর্কে নেতৃত্বের তত্ত্বগত ধারণাকে বুঝতে চেষ্টা করার চাইতে সাফল্যের ব্যাপারে কর্মী-সংগঠকদের আবেগিক অবস্থান আন্দোলনের ভাঁটার টানে স্বাভাবিকের চাইতে বেশি মাত্রায় নিষ্ক্রিয়তার জন্ম দেয়। এই দু’টি গণ-প্রক্রিয়া তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করার আগেই শুকিয়ে যায়। একটি প্রাণবন্ত প্রক্রিয়া শুকিয়ে গেলেও তার আবেদনের রেশ থেকে যায় বহুদূর পর্যন্ত, বহুদিন ধরে। কিন্তু শুকিয়ে যাওয়া কী ঐতিহাসিকভাবে অবশ্যম্ভাবী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে দেওয়া কঠিন, কারণ এগুলি এখনও ইতিহাসের চর্চার বিষয় হতে বাকি।
যখন এই দু’টি প্রক্রিয়া চলছিল সেই সময়টা ছিল ভারতীয় সমাজের এক উৎক্রমণকালীন সময়। গোষ্ঠী-সমাজ ভাঙছে শ্রেণি-সমাজ তার জায়গা নিচ্ছে। মণ্ডল – কমণ্ডলের অস্থির পরিস্থিতি এই ভাঙা গড়ার প্রতিফলন, এর উপর চলছিল উদারবাদের কাঠামোগত পুনর্গঠনের প্রভাব। একটি বাস্তব সময়ে নিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজের অভ্যন্তরীণ রসায়ন উপলব্ধি করা বেশ জটিল কাজ, ফিরে দেখার সময় যা চোখে পড়ে বাস্তব সময় পর্যবেক্ষকের চোখকে তা ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, এবং সেজন্যই সফলতা ও বিফলতা অনেকাংশেই ঐতিহাসিক সমাপতন। আজ ফিরে তাকালে মনে হয়, সেই উৎক্রমণকালীন পর্যায় দাবি করছিল পরিচিতির অধিকার ও বৈচিত্র্য রক্ষার প্রশ্নে ও শ্রেণি অধিকারের প্রশ্নে যুগপৎ হস্তক্ষেপ। তাতে আন্দোলনের ভাঁটার সময় যে নিষ্ক্রিয়তার জন্ম দিয়েছিল তা হয়তো দিত না।
আমার ধারণা, সামাজিক সম্পর্ক দু’টি বিপরীতমুখী পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। কখনও বহুবিধ স্বার্থ একে অপরের উপরের প্রভাব বিস্তার করে থাকে এবং তখন ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের উল্লম্ফনের কোনো সুযোগ থাকে না, থাকে সবকিছুতে যুগপৎ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রস্তুতির সম্ভাবনা। সামাজিক সম্পর্কের এই পরিস্থিতি অতিক্রম করে বিষয়ীগত শক্তির ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে কোনো এক স্বার্থ বাকি সবকিছুর উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলে এবং তখনই আবির্ভূত হয় ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে নির্ধারক আঘাত করার সময়। ভারতীয় সমাজ গোষ্ঠীগত স্বার্থ থেকে বহুবিধ স্বার্থের পর্যায় পেরিয়ে শ্রেণি স্বার্থের প্রাধান্যের অবস্থায় উপনীত হচ্ছে বলেই মনে হয়। অর্থাৎ সেই মুহূর্তটি সমাজ-রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হচ্ছে যখন শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ পরিচিতি ও ভারতীয় জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করছে।
Leave a comment